
সেই থেকে আমি সত্যজিৎ রায়কে সমালোচনার চোখে দেখছি। ব্যাপারটা আসলে প্রচন্ড অভিমান থেকে এসেছে। লোকটা মরেছে, বেচারা এখন সকল প্রকার জাগতিক আলোচনা-সমালোচনার উর্ধ্বে। কিন্তু তবু মৃত্যুর আগে যে ক্ষত তিনি সৃষ্টি করে গিয়েছেন, নিজের মনকে মানাতে পারিনা। অপাত্রে শ্রদ্ধা আর ভালবাসা দিয়েছিলাম এতদিন? যে মানুষটাকে এত শ্রদ্ধা করতাম, ভালবাসতাম, সেই মানুষটি আমার দেশ ও আমার দেশের মানুষকে এমন করে অপমান করতে পারলো? মানুষের ভেতর তো সৌজন্যতাবোধ সহজাত। গুনী মানুষের ভেতর তো সেটা আরো বেশী পরিমানে থাকার কথা।
কাকতালীয় ব্যাপার, ঠিক এর পর থেকে আমি বেশ কিছু রেফারেন্স পেয়েছি যেখানে সত্যজিৎ রায়ের ঔদ্ধত্য ও ‘আলগা মাতবরি’ প্রমানিত হয়েছে। আর এও প্রমানিত হয়েছে, আমাদেরকে অপমানিত করার পরও রায় সাহেবকে নিয়ে আমাদের দেশের গুনীমহলে রীতিমতোন আদিখ্যেতার কোন শেষ নেই। [পৃষ্ঠা নং ৫২ –তে জনাব মুস্তফা মনোয়ার প্রসংগ দ্রষ্টব্য]।
তারেক মাসুদ রচিত ‘চলচ্চিত্র যাত্রা’ কিছুদিন আগে পড়া শুরু করেছি। তারেক সাহেবকে এতদিন ভাবতাম তিনি শুধুমাত্র একজন প্রথিতযশা চলচ্চিত্রকার, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং রবীসাহিত্য নিয়ে তিনি যে কতটা গভীর দৃষ্টিবোধ ও দর্শন নিজের ভেতর লালন করে গিয়েছেন, তা বইটি পড়ে জেনেছি এবং জেনে বিস্মিত হয়েছি। তিনি সত্যজিৎকে নিয়ে গঠনমূলক সমালোচনা করেছেন। একজন প্রতিভাধর ফিল্মমেকার যখন আরেকজন প্রতিভাধর ফিল্মমেকারকে নিয়ে সমালোচনা করেন, আমার ধারনা সেটা সবসময়ই খুব আগ্রহীদ্দপক হয়। তার উপর সেটা যদি তারেক মাসুদের মতো বিনয়ী ও বিদগ্ধ ব্যক্তির কাছ থেকে আসে, তাহলে তো কথাই নেই।
তো সে বইয়ে সত্যজিৎকে নিয়ে মোট তিনটি অধ্যায় রয়েছে। সেখান থেকে আমি সত্যজিৎ রায়কে বেছে বেছে বইয়ের পৃষ্ঠাকে ছবিতে পরিণত করে একটা এ্যালবাম বানালাম। সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে যত প্রকার সমালোচনা পাবো, সেগুলোর ছবি তুলে এখানে তুলে রাখার নিমিত্তে। একটা আর্কাইভ হবে বলা যায়।
বি:দ্র: ছবিগুলো খুব রিচ ফরম্যোটে দেয়া হয়েছে। ফেসবুকে পড়তে কারো সমস্যা হলে তিনি সরাসরি ডাউনলোড করে নিয়ে জুম করে দেখতে পারবেন।
আমার ১ম রেফারেন্স হলো, প্রথমালোর সাজ্জাদ শরীফ ও হুমায়ূন আহমেদের জবানীতে জানতে পারা আবুল আহসান চৌধুরীর ঘটনাটা। ফেসবুকে দেয়া আমার পুরনো স্ট্যাটাসের আর্কাইভ ঘেটেঁ এখানে হুবহু তুলে দিলাম: সত্যজিৎ রায় আমার খুব পছন্দের একজন লেখক (ছিলেন)। আমি তারঁ লেখা এবং চলচ্চিত্রের একজন একনিষ্ঠ ভক্ত (ছিলাম)। বিশেষ করে ২০০৩ সালে প্রফেশর শংকু সমগ্র কেনার পর বইয়ের উপর পেন্সিল দিয়ে ডিজাইন করে লিখেছিলাম – “সত্যজিৎ ওয়াজ এ জিনিয়াস!” পথের পাচাঁলি দেখে মুগ্ধ বিস্ময়ে মূঢ় হয়েছি বহুবার।
কিন্তু সম্প্রতী যা জানতে পারলাম, তা আমাকে ব্যথিত এবং আহত করেছে প্রবলভাবে। এবং সেটা জানার পর আমার পছন্দের লেখকের তালিকা থেকে সত্যজিৎ রায়কে মুছে ফেলেছি। তারঁ সৃষ্টিকে হয়তো আমি আজীবন পছন্দ করে যাবো, কিন্তু তাকেঁ কখনই নয়। ব্যক্তি সত্যজিৎ-এর সন্মান এবং গ্রহযোগ্যতা আমার কাছে ফুরিয়ে গেছে।
ব্যাপারটা আপামর বাংলাদেশীদের জন্য ঠিক হীনমন্যতার না হলেও, যারা পশ্চিমবংগের শিল্পী এবং/অথবা মিডিয়ার প্রতি আল্হাদে গদগদ হয়, তাদের ব্যাপারটি স্রেফ হীনমন্যতা ছাড়া আর কিছু নয়।
হুমায়ূন আহমেদ এই ঘটনা সর্বপ্রথম তুলে ধরেছিলেন। যারা সত্যজিৎ-এর ভক্ত, তারা ঘটনাটা জানেন কিনা জানি না, তবে যারা জানেন না, তারা জানার পর চমকে উঠতে পারেন, প্রচন্ড কষ্ট পেতে পারেন এবং হীনমন্যতায় ভুগতে পারেন।
আমি হুমায়ূন আহমেদের বয়ানটি হুবহু তুলে দিচ্ছি –
[ “বাংলাদেশের শিল্পীদের ভেতর যেমন হীনমন্যতার ব্যাপার আছে, তেমনি লেখকদের মধ্যেও আছে। তার একটি গল্প বলি।
বাংলাদেশের জনৈক লেখক (নাম বলতে চাচ্ছি না) গিয়েছেন কলকাতায়। সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে দেখা করবেন। বাড়ি খুজেঁ বের করে অনেক্ষন কলিংবেল টেপাটেপি করলেন। তাকেঁ অবাক করে দিয়ে সত্যজিৎ রায় নিজেই দরজা খুললেন। তবে পুরোপুরি খুললেন না। প্রবেশপথ বন্ধ করে দাড়িঁয়ে রইলেন। লেখক ভেতরে ঢুকতে পারছেন না। লেখক বললেন, আমার নাম অমুক। আমি বাংলাদেশের একজন লেখক। বাংলাদেশ থেকে এসেছি। নানান বিষয়ে, বিশেষ করে শিশু সাহিত্যে আমার প্রচুর বই প্রকাশিত এবং সমাদৃত হয়েছে।
সত্যজিৎঃ ও আচ্ছা।
লেখকঃ আমি আপনার ঠাকুরদা উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর উপর বিশাল একটি বই লিখেছি।
সত্যজিৎঃ ও আচ্ছা।
লেখকঃ আমি আপনার ববা সুকুমার রায়ের জীবন ও কর্ম নিয়ে আমি একটি বই লিখেছি।
সত্যজিৎঃ হুঁ।
লেখকঃ আমি আপনার উপরও একটি বই লিখেছি।
সত্যজিৎঃ ধন্যবাদ।
লেখকঃ আপনার উপর লেখা বইটি আমি নিজের হাতে আপনাকে দিতে এসেছি।
সত্যজিৎঃ আমার বাড়িটা ছোট। এত বই রাখার জায়গা আমার নেই। কিছু মনে করবেন না।
কথপকোথন এখানেই শেষ। সত্যজিৎ রায় এরপর দরজা বন্ধ করে দিলেন। বাংলাদেশী লেখক এই অপ্রত্যাশিত আচরনে হতভম্ব হয়ে গেলেন।
আমি এই গল্পটি অনেকের কাছে শুনেছি। শেষবার শুনেছি ‘প্রথম আলো’ পত্রিকার সাজ্জাদ শরীফের কাছ থেকে। যারা ঐ লেখকের নাম জানতে আগ্রহী, তারা সাজ্জাদ শরীফের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন।
—- হুমায়ূন আহমেদ, দেখা-না দেখা, প্রকাশকাল ২০১১, ১১০ পৃষ্ঠা। ]
ভিনদেশী এবং সমগোত্রীয় একজন অতিথির সাথে বিখ্যাত একজন ব্যাক্তিত্বের এই অভব্যতার কারনসমূহ কি কি হতে পারেঃ-
১. রায় বাবুর তখন মুড ভালো ছিলো না। (খুবই খোড়াঁ একটি কার্য কারন)
২. বাংলাদেশের লেখকদের ব্যাপারে তার অভিজ্ঞতা ভালো নয়।
৩. বাংলাদেশকে সে গোনায় ধরে না।
৪. বাংলাদেশের ভক্তদেরো সে গোনায় ধরে না।
৫. বাংলাদেশের লেখকদেরো সে লেখক বলে মনে করে না।
এত সব কিছু সত্য হলেও, বাঙ্গালী এবং সজ্জনব্যক্তির স্বাভাবিক অথিতিপরায়তাকে মাথায় রেখে বলছি, রায় বাবুর উচিত ছিলো লোকটার উপহারটাকে অন্ততঃ গ্রহন করা। না গ্রহন করে (অভদ্রতার কথা তো বাদই দিলাম) সে যে নিচু এবং দাম্ভিক মনের পরিচয় দিয়েছে, সেটা তো বলাই বাহুল্য।
আর ঐ লেখকটিরও নিশ্চয়ই এতদিনে কলকাতা প্রিতী/সত্যজিৎ প্রিতীর রোগ সেরে গেছে! এবং সে মাই ডিয়ার টাইপ লোক, নাহলে তো নিশ্চয়ই্ কলকাতা থেকে ফিরে এই ঘটনা বাংলাদেশের মানুষের সামনে তুলে ধরতো, গোপন রাখতো না।
আমার পছন্দের লেখকদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আমি কখনই মাথা ঘামাইনি। আমি তাদের লেখাকে ভালবেসেছি। সেইসাথে তাদের বিশ্বাস, আর্দশ এবং দর্শন আমাকে প্রভাবিত করেছে। সত্যজিৎ রায়কে যখন দেখি আমার দেশ, দেশের মানুষ আর একজন লেখকের প্রতি সজ্ঞানে অসন্মান-অপমান, তখন সেটা আমাকে ব্যক্তি সত্যজিৎকে ঘৃনা করতে শেখায়। আমি জানি না সে লেখকের নাম-পরিচয় কি, কিন্তু সে আমার দেশের লেখক, এইটুকু পরিচয়ই আমার জন্য যথেষ্ঠ। এবং সুযোগ পেলে আমি ঠিক একই কাজ করে হয়তো প্রতিশোধ নিতাম যেটা অজ্ঞাত লেখকের সাথে করা হয়েছিলো। কারন, ভিনদেশী সমগোত্রীয় একজন মানুষ দ্বারা প্রচন্ড অপমানিত হবার অভিজ্ঞতাটি কেমন, সেটা তাকেঁ জানিয়ে দেয়াটা দায়িত্ব বলে মনে করতাম।